রাকিবুল হাসান
একটি ক্যাফেতে বোমা হামলার দৃশ্য। নেপথ্যে শোনা যায়, ‘মানুষ যখন ধর্মের নামে হত্যা করে, আসলে সে ধর্মকেই হত্যা করে, মনুষ্যত্বকে হত্যা করে।’ গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারির নৃশংস জঙ্গি হামলার ঘটনা নিয়ে বলিউডের ‘ফারাজ’-চলচ্চিত্রের ফার্স্টলুক এটি। মৃত্যুর মুখেও দুই বন্ধু অবিন্তা কবির ও তারিশি জৈনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ২০ বছরের তরুণ ফারাজ আইয়াজ হোসেন। শেষ পর্যন্ত তাদের বাঁচাতে পারেননি, নিজেও বাঁচেননি। কিন্তু বাঁচিয়েছিলেন সাহস, বন্ধুত্ব আর মানবিকতাকে। সেই গল্প নিয়েই পরিচালক হংসল মেহতা নির্মাণ করছেন এই চলচ্চিত্রটি।
টুইটার ও ইনস্টাগ্রামে এই চলচ্চিত্রের ২৩ সেকেন্ডের একটি মোশন পোস্টার প্রকাশ করা হয়েছিল কয়েক বছর আগে। ভিডিও পোস্টে পরিচালক হংসল মেহতা লিখেছিলেন, ‘সহিংস প্রতিকূলতার মধ্যেও মানবতার জয়!'
চলচ্চিত্রটি নিয়ে নির্মাতা ভারতীয় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ফারাজ’-এর গল্পটি পৃথিবীকে দেখাবো বলে অপেক্ষা করছি। ‘ফারাজ’ হবে গভীর মানবিকবোধের এক গল্প। কিন্তু ছবিটি নির্মাণে আপত্তি তুলে অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের পক্ষে বাংলাদেশের ল’ ফার্ম লিগ্যাল কাউন্সেল ছবিটির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান টি-সিরিজ, চলচ্চিত্র নির্মাতা ভূষণ কুমার, সহকারী প্রযোজক অনুভব সিনহা এবং পরিচালক হংসল মেহেতাকে উকিল নোটিশ পাঠায়। নোটিশের উল্লেখ করা হয়, ‘এ ধরণের চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হলে তা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও সুনাম নষ্ট করবে, যার নেতিবাচক প্রভাব গোটা বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে চরম ক্ষতির মুখে ঠেলে দেবে। তাছাড়া, এ ধরণের চলচ্চিত্র নির্মিত হলে তা বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে একটি সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে চিত্রিত করবে, যা আদতে সত্যি নয়।’ আইনি নোটিশ পাঠানোর পর অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের পক্ষে অবিন্তার মা মামলাও করেছেন।
২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে পাঁচ জঙ্গি সদস্যের পরিচালিত হামলার ঘটনায় যে ২২ জন দেশি-বিদেশি নাগরিক নিহত হন, তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত ২০ বছর বয়সী বাংলাদেশি তরুণ ফারাজ আহমেদও ছিলেন। তাকে কেন্দ্র করেই ‘ফারাজ’ নামের চলচ্চিত্র তৈরির ঘোষণা দিয়েছিলো বলিউডের অন্যতম প্রযোজনা সংস্থা টি-সিরিজ। কিন্তু মামলার ফলে, চলচ্চিত্রটি এখনও মুক্ত হয়নি।হলি আর্টিজান হামলা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশেও মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ‘শনিবার বিকেল’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ‘দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে’ অভিযোগে চলচ্চিত্রটিকে সেন্সর সনদ দেয়া হয়নি।
‘শনিবার বিকেল’ চলচ্চিত্রটি সাড়ে তিন বছর ধরে আটকে থাকার নেপথ্য ঘটনা আসলে কী? ২০১৯-এর ৯ জানুয়ারি ছবিটি দেখে সেন্সর বোর্ডের অনেকে পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছিলেন, ছবিটি মুক্তির সনদ দেওয়া হবে। যারা তখন বোর্ডের সদস্য ছিলেন তাদের কেউ কেউ এখনও বলছেন, সিনেমা হিসেবে ছবিটি নিয়ে তাদের কোনও আপত্তি ছিল না। ছবিটি আটকে যাওয়ার কারণ হিসেবে যা জানা গেছে, প্রথমবার ছবিটি দেখার পর সেন্সর বোর্ডের সচিব একটি নোট লিখেছিলেন। সেখানে লেখা ছিল, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব না দেখা পযর্ন্ত যেন ছবিটি পাশ না করা হয়। পরে তখনকার তথ্য সচিব ছবিটি দেখেন। সেসময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবও তার সঙ্গে ছিলেন। তখন ছবিটি আটকানোর পক্ষে সবাই মত প্রদান করেন। তাদের বক্তব্য ছিল, ‘ভুলে যাওয়া একটি বিয়োগান্তক ঘটনা নতুন করে মনে করিয়ে দেয়াটা ঠিক হবে না। এতে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে।’
বিষয়টি নিয়ে আপিল করা হলে, কয়েকজন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বকে ডেকে ছবিটি দেখিয়ে তাদের মতামত চাওয়া হয়। তারা আটকে রাখার মতো কোনও কিছু এই চলচ্চিত্রে পাননি বলে মতামত দেন। এরপর চলচ্চিত্রটিকে প্রদর্শনী করার অনুমতি দেয়া হবে কী না-এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার আপিল বোর্ডের। আপিল বোর্ডের অন্যতম সদস্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব। এখন তার সিদ্ধান্তের উপরেই নির্ভর করছে ‘শনিবার বিকেল’ চলচ্চিত্রটির সেন্সর বোর্ডের সনদ পাওয়া বা না পাওয়া।
‘শনিবার বিকেল’ চলচ্চিত্রটি মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর একটা থ্রিলারধর্মী চলচ্চিত্র, যা ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান হামলা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। হলি আর্টিজানে ৫ জঙ্গি কর্তৃক বিদেশি নাগরিকসহ প্রায় ৫০ জনকে জিম্মি করা এবং ২২ জনকে হত্যার ঘটনা সত্য এবং হৃদয় বিদারক। এটাও সত্য যে, ১ জুলাইয়ের জঙ্গি হামলার পর ২ জুলাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনার মাধ্যমে জিম্মিদের উদ্ধার করা হয়। এসময় সকল জঙ্গি নিহত হয়। সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার পর এই ঘটনায় বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার কোনও কারণ আমি দেখি না। কোনও চলচ্চিত্রে যদি ঘটনাকে বিকৃত করে শুধু জঙ্গি হামলা দেখানো হয় এবং জঙ্গি দমনকে না দেখানো হয়, তাহলেই ভাবমূর্তি নষ্টের প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু ‘ফারাজ’ এবং ‘শনিবার বিকেল’ চলচ্চিত্র দুটোর কোনওটাতেই এমনটা দেখানো হয়নি বলেই জানি।
বাংলাদেশে সেন্সর সার্টিফিকেট না পেলেও মিউনিখ, মস্কো, সিডনি, বুসান, প্যারিসসহ বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘শনিবার বিকেল’ প্রদর্শিত হয়েছে। বহু দেশের প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক ছবিটি দেখেছেন এবং বাংলাদেশে সেন্সর সনদ না পাওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ অনেকেই ছবিটি আটকে রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। যে ‘ভাবমূর্তি নষ্টে’র প্রশ্ন তুলে সেন্সর বোর্ড একটা চলচ্চিত্রকে আটকে রাখে, তাদের কাছে ‘ভাবমূর্তি’র সংজ্ঞা কী?
বাংলাদেশের সংবিধান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা অন্য কোনো আইনে দেশের ভাবমূর্তির কোনো সংজ্ঞা দেওয়া নেই। এমনকি, দণ্ডবিধিতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ ও রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধগুলোর বর্ণনায়ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির কোনো উল্লেখ নেই। ফলে, আমি যদি কোনও কিছুকে ন্যায্য ও বৈধ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মনে করে প্রকাশ করি, সেটিকেও একজন অভিযোগকারী দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী মনে করতে পারেন। ব্যক্তিভেদে এর সংজ্ঞায়ন ভিন্ন হতেই পারে আর এই কারণেই এটা হচ্ছে একটা সমাধান অযোগ্য সমস্যা। প্রকৃত পক্ষে, একটা দেশের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার কতটা আছে, ‘দেশের ভাবমূর্তি’র পরিমাপক হওয়া উচিত সেটাই। এসব অধিকারের অংশ হচ্ছে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বহুদলীয় ব্যবস্থা এবং জনগোষ্ঠীর সব অংশের অংশগ্রহণ, সরকার পরিচালনায় স্বচ্ছতা, দুর্নীতির মাত্রা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তা ও গবেষণার স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো।
ভাবমূর্তি নষ্ট হয় বড় বড় প্রকল্পের দুর্নীতিতে, বিনা বিচারে হত্যাকান্ডে, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারে। সত্য প্রকাশে, শিল্প চর্চায় দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় না। এই বোধোদয় আপনাদের কবে হবে? ‘শনিবার বিকেল’ মুক্তি পাক কোনও এক শুক্রবার সকালে; সেই প্রত্যাশায় রইলাম।
লেখক: শিক্ষক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা