বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উড়িয়ে এগিয়ে চলছেন মুক্তিযোদ্ধা। শক্ত মুষ্টিতে পতাকার ঝাণ্ডা গভীর মমতায় বুকের সঙ্গে আলিঙ্গন। ডান কাঁধে তাঁর ঝোলানো রাইফেল। তাঁরই বাঁ পাশে রাইফেল হাতে আরেক মুক্তিযোদ্ধা। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা গর্বিত সেই যোদ্ধার চোখ আকাশপানে। পাশেই রাইফেল ও হেলমেট উঁচিয়ে উল্লসিত আরো দুই মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের একজনের খালি পা, পরনে লুঙ্গি। ত্রিভুজ আকৃতির বেদির ওপর ভাস্কর্যের আরেক দিকে দুহাতে শান্তির পায়রা উড়িয়ে যুদ্ধ শেষে আগামী দিনের শান্তির বার্তা আকাশে ছড়িয়ে দিচ্ছেন এক নারী। এই উল্লাসে তাঁদের সঙ্গে শরিক গুলতি হাতে এক দুরন্ত কিশোরও। মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা যশোরের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘বিজয়-৭১’ এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে শহরের পালবাড়ী মোড়ে।
যশোরের এস এম সুলতান আর্ট কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ খন্দকার বদরুল আলম নান্নুর হাতের পরশে ভাস্কর্যটি এখনো ছড়াচ্ছে দীপ্তি। যশোর জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নির্মিত এই ভাস্কর্যটি ১৯৯৮ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধকালীন ৮ নম্বর সেক্টরের প্রথম দিকের কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী বীর-উত্তম। মূল ভাস্কর্যটি ২৭ ফুট উচ্চতার। বেদিসহ উচ্চতা ৩৫ ফুট। ভাস্কর্যটি নির্মাণের উপকরণ ছিল হোয়াইট সিমেন্ট, চুনাপাথর ও রড। ভাস্কর্যটি নির্মাণে এক বছরেরও বেশি সময় লাগে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন বিএলএফের বৃহত্তর যশোর জেলার উপপ্রধান ( ডেপুটি লিডার) রবিউল আলম ছিলেন এই ভাস্কর্য নির্মাণ কমিটির সদস্য। তিনি বলেন, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ৬ ডিসেম্বর দেশের প্রথম শক্রমুক্ত হয় যশোর। এটিই যশোরের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য। যশোরের মুক্তিযোদ্ধারা সে সময়ের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মুক্তিযোদ্ধা মালেক মিয়ার কাছে একটি ভাস্কর্য নির্মাণের প্রস্তাব দেন। ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য ডিসি মালেক মিয়াকে সভাপতি করে ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সদস্য ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা রবিউল আলম, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই, মাস্টার নূর জালাল, পিলু খান, একরাম-উদ-দৌলা প্রমুখ। এই ভাস্কর্য নির্মাণে সেই সময় প্রায় ১২ লাখ টাকা ব্যয় হয়।
পালবাড়ী মোড়ে ভাস্কর্যটি স্থাপনের বিষয়ে তিনি জানান, পালবাড়ীর পাশেই যশোর ক্যান্টনমেন্ট, সে সময় পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ছিল। চৌগাছা ও বেনাপোল থেকে মিত্রবাহিনী এই দুই পথ দিয়ে এসে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ও শহরে প্রবেশ করে। একই সঙ্গে আশপাশের মুক্তিযোদ্ধারাও এই দিক দিয়ে প্রবেশ করেন। আবার এই সড়ক দিয়েই পাকিস্তানি হানাদাররা ক্যান্টমেন্ট ছেড়ে খুলনার দিকে পালিয়ে যায়। পাশাপাশি এটা যশোর শহরে প্রবেশেরও একটা পথ। এসব দিক বিবেচনা করেই ভাস্কর্যটি এখানে নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।
ভাস্কর্য ‘বিজয়-৭১’ নির্মাণ কমিটির আরেক সদস্য মুক্তিযোদ্ধা একরাম-উদ-দৌলা বলেন, পরবর্তী প্রজন্মকে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাশাপাশি এ সম্পর্কিত সব তথ্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।