Logo
শিরোনাম

শেখ রাসেল: অমিত সম্ভাবনার অকাল মৃত্যু

প্রকাশিত:রবিবার ১৭ অক্টোবর ২০২১ | হালনাগাদ:সোমবার ২৭ নভেম্বর ২০২৩ | ৫৬৩০জন দেখেছেন
নিউজ পোস্ট ডেস্ক

Image

শেখ রাসেল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ উত্তরাধিকার। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ভুবন আলোকিত করা উজ্জ্বল নক্ষত্র। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়ণের মনি, আদরের ছোট ভাই। অমিত সম্ভাবনা জাগিয়ে যে নক্ষত্র অকালেই হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। কিন্তু আসলেই কি শেখ রাসেল হারিয়ে গেছে? না, শেখ রাসেল হারিয়ে যায়নি। জাগতিক অস্তিত্বের ঊর্ধ্বে উঠে গেলেও শেখ রাসেল প্রতিটি বাঙালির অস্তিত্বে অমর, অবিনাশী হয়ে বেঁচে থাকা এক সত্তার নাম। তাঁর নির্মল, নিষ্পাপ অথচ তেজোদীপ্ত চোখ আজও ভাস্বর।

পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও উৎকন্ঠার সময়ে যখন বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগরুক, ঠেক সে সময়েই ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর হেমন্তের এক প্রহরে ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধু পরিবার আলো করে জন্ম নেয় ফুটফুটে শিশু রাসেল। নোবেল জয়ী ব্রিটিশ দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেলকে পছন্দ করতেন বলে নামে বঙ্গবন্ধু কনিষ্ট তনয়ের নাম রাখের রাসেল। শিশু রাসেলের জন্ম নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে, রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজ ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেজ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখবো। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালোচুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড় হয়েছিল রাসেল”।

ছোট বয়সেই শেখ রাসেলের মানবতাবোধ, ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষ, নেতৃত্বের সৌকর্য, পরোপকারী মনোভাব আর দশজন শিশু থেকে তাঁকে স্বাতন্ত্র্য অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। জাতির পিতার প্রতিচ্ছবি ছিলেন শিশু রাসেল। টুঙ্গিপাড়ায় বেড়াতে গেলে শিশু রাসল তাঁর সমবয়সীদের জড়ো করে তাতের জন্য খেলনা বন্দুক বানাতেন আর সেগুলো দিয়ে তাদের প্যারেড করাতেন। বন্ধুদের জন্য তিনি জামাকাপড় কিনে দিতেন। বাবা ও বোন শেখ রেহানার সঙ্গে যখন বিদেশ ভ্রমণে গিয়েছিল ছোট্ট রাসেল, তখন প্রিন্সকোট পরা এই শিশুর ব্যক্তিত্বে বিমোহিত হয়েছেন বিশ্ব নেতারা। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে জাপান সফরে যান বঙ্গবন্ধু। শেখ রাসেলের বয়স তখন মাত্র ৯। কিন্তু তার প্রাণবন্ত কিন্তু পরিমিত হাসি, আত্মবিশ্বাসী চাহনি, করমর্দনের ধরণ সবকিছুর মধ্যেই ফুটে উঠেছিল একজন ভবিষ্যত নেতার ছাপ। আবার ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের বেঞ্চে যখন সে বসতো, তখন হয়ে যেতো সহপাঠীদের খুব নিকটজন। বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া টিফিনটাও ভাগ করে খেতেন বন্ধুদের সাথে। রান্নাঘরে কাজের মানুষরা যখন খেতে বসতো, তখন লাল ফুলতোলা প্লেট নিয়ে তাদের সঙ্গে খেতে বসে যেতেন। বাঙালি জুলফিকার আলী ভুট্টো, বাঙালি জাতিকে শোষণ করার প্রতিকে পরিণত হয়েছিল। তার প্রভাব পড়েছিল শিশু শেখ রাসেলের মনে। ওই বয়সে তিনি হয়তো অতো রাজনীতি বুঝতো না। কিন্তু বিভিন্ন শ্লোগান ও আলোচনার কথা শুনে এটা বুঝতে শিখেছিল যে ভুট্টো নামটা একটা নেতিবাচক শব্দ, এটা একটা শোষকের নাম। একবার বড় আকারের এক কালো পিঁপড়া (ওলা) কামড়ে দেওয়ায় ফুলে গেল শিশু রাসেলের আঙুল। ওই আক্রমণকারী বড় কালো পিঁপড়ার নাম দিল সে ভুট্টো। যুদ্ধমুখর দেশে, রাজনৈতিক আবহে বেড়ে ওঠা শৈশবে, অবচেতনভাবেই এক তীব্র সচেতনতা বোধের সৃষ্টি হচ্ছিল ছোট্ট রাসেলের মনে।

শেখ রাসেলের জন্মের পর বঙ্গবন্ধু অনেকটা সময় কারা অন্তরীণ ছিলেন। যার কারণে বাবার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ঐ সময়টায়। বাবার অনুপস্থিতিতে তাঁর অনেকটা সময় কাটতো তার প্রিয় হাসুপার (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সাথে। আর বাবাকে কাছে না পেয়ে মা ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে আব্বা’ বলে সম্বোধন করতেন রাসেল। আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ের একুশ পৃষ্ঠায় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন, আব্বার সঙ্গে প্রতি ১৫ দিন পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইত না। খুবই কান্নাকাটি করত। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে, আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা বাসায় ফেরত যাব। বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর আব্বার মনের অবস্থা কী হতো, তা আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায় আব্বার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বোঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখাতেন। মাকেই আব্বা বলে ডাকতো”। বাবাকে কাছে না পাওয়ার কষ্ট যেমন অনুভব করতেন শিশু রাসেল, ঠিক তেমনি বাবা মুজিবও। কারাগারের রোজনামচা’য় শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো। কী উত্তর ওকে আমি দেবো। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম, ওতো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ও কী বুঝতে চায়! কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে-মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে”।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আর দশটা দিনের মতো ছিলনা। বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে অমানিশার অন্ধকার নেমে আসা সেই দিন পিতা-মাতা ও তাঁর ভাই-ভাবীদের সাথে ঘাতকের নির্মম বুলেট বিদীর্ণ করেছিল শিশু রাসেলের বুক। মায়ের কাছে যাওয়ার অনন্ত আকুতিকে পদদলিত করে কিছু নরপিশাচ চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছেল শেখ রাসেলের কন্ঠস্বর।

বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম আর  বাংলাদেশের জন্মের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের সাক্ষী হয়ে বেড়ে উঠেন শেখ রাসেল। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ছয় দফা প্রণয়ন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মহান স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশ পুনর্গঠন এসবগুলো ঘটনার মধ্যে যার জন্ম ও বেড়ে ওঠা, তিনি শেখ রাসেল। বাঙালি জাতির আত্মপ্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে ডানা মেলেছে তার শৈশব। বাল্যকালেই যে সচেতনতা, মানবতাবোধ ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছিল তার জীবনাচরনে, সেটা প্রস্ফুটিত হলে বঙ্গবন্ধুর মতোই আজ বিশ্বব্যাপী মানবতাবাদী নেতৃত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতেন তিনি। তিনি হতে পারতেন আধুনিক বাংলাদেশের একজন উজ্জ্বল পথিকৃৎ। হতেন বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও রাজনৈতিক আদর্শের যথার্থ উত্তরসূরি। কিন্তু অমিত সম্ভাবনার অকাল মৃত্যু ঘটেছিল ৭৫ এর ১৫ আগস্ট শেখ রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে। এটি বাঙালি জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। শেখ রাসেলের নাতিদীর্ঘ জীবন নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন। তাঁর জীবনাচরণ, চিন্তা-চেতনা, আদর্শ শিশু-কিশোরদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। তাই শেখ রাসেলের জীবনীপাঠ সময়ের দাবী।

লেখকঃ শ ম রেজাউল করিম এমপি, মাননীয় মন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।


আরও খবর

শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এখনও অপরিহার্য

বৃহস্পতিবার ১৫ ডিসেম্বর ২০২২