Logo
শিরোনাম

সন্তানের শিক্ষা খরচ বাড়ায় অসহায় অভিভাবকরা

প্রকাশিত:মঙ্গলবার ১৯ এপ্রিল ২০২২ | হালনাগাদ:শনিবার ২৫ নভেম্বর ২০২৩ | ১১২০জন দেখেছেন
নিউজ পোস্ট ডেস্ক

Image

রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী হাবিবুল্লাহ কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের আগে তার দুই ছেলের পড়ালেখার জন্য মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ করতেন। এখন তাকে আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ খরচ করতে হচ্ছে।  ২০২০ সালের মার্চ থেকে হাবিবুল্লাহর বেতন বাড়েনি, এ কারণে তার নগদ উপার্জন থেকে সরাসরি খরচ বেড়েছে। বেতন কাটার কারণে মহামারির সময় আরও কম আয় ছিল তার।

হাবিবুল্লাহ বলেন আমার এক ছেলে নবম শ্রেণীতে, অন্যজন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। ২০২০ সালে দুইজনের জন্যই ৩ হাজার টাকা করে দিয়ে একজন হোম টিউটর রেখেছিলাম। এখন আমাকে প্রতিটি টিউশনের জন্য ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। এমনকি, রিকশা ভাড়া আর টিফিনের মতো অন্যান্য খরচও বেড়েছে।  প্রতিমাসে পাই ৩০ হাজার টাকা। এখন আমার সন্তানের পড়ালেখার জন্যই মাসে ১৬ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। আমার বেতনে প্রয়োজনীয় খরচ চালাতে টানাটানি হয়, এভাবে চলা কঠিন হয়ে যাবে।

দেশজুড়ে অনেক অভিভাবকের অবস্থাই অনেকটা এমনই: আয় কম, খরচ বেশি।  ইউনেস্কোর ২০২১/২ গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট বলছে, শিক্ষার পেছনে গড় খরচ বেড়েছে ৮০ শতাংশ।  প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ৭ শতাংশ পরিবারকে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে ঋণ নিতে হয়।

বাংলাদেশ গার্ডিয়ানস' ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলুবলেন, দেশে উল্লেখযোগ্য হারে শিক্ষার খরচ বেড়েছে, অতিরিক্ত খরচ বহন করতে অভিভাবকদের নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজন সংকোচন করতে হচ্ছে।  গাইড বই, স্কুল কপি ও স্টেশনারির দাম বেড়েছে। এমনকি রিক্সায় উঠতেও মহামারির আগের সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া গুণতে হচ্ছে। হোম টিউটরদেরও বেশি বেতন দিতে হচ্ছে। বেশিরভাগ অভিভাবকের বেতনই বাড়েনি, অনেকের উল্টো কমেছে।

ইস্কাটন গার্ডেন এলাকার একজন ব্যবসায়ী রুমেন মৃধা বলেন, মহামারি শুরুর পর তার বেতন কমেছে। প্রায় ৫০-৬০ হাজার থেকে কমে ৩০ হাজার হয়েছে। একই সময়ে, তার দুই সন্তানের শিক্ষার খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আমার আয়ে মহামারির প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। এখন নিত্য দৈনন্দিন খরচ মিটিয়ে শিক্ষা খরচ মেটানো হয়ে পড়েছে আমার জন্য। এ কারণে আমি ব্যবসা ছেড়ে চাকরিতে ঢোকার বা একেবারেই দেশ ছাড়ার চিন্তা করছি।

এমন পরিস্থিতিতে এ ধরনের  'আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার' কমানোর দাবি জানাচ্ছেন অনেকেই।  গলাকাটা স্কুল ফি ছাড়াও আরেকটি বড় খরচের খাত প্রাইভেট টিউশন ফি।  বাংলাদেশ টিউটর প্রোভাইডারস' অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধি, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি আর রাস্তায় যানজটের কারণে টিউশন ফি দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে।

বাংলাদেশ টিউটর প্রোভাইডারস' অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য ও টিউটরস' ক্লাবের মালিক মো. মাইনুল ইসলাম বলেন, নিজেদের পড়াশোনার খরচ চালাতে প্রধানত শিক্ষার্থীরাই প্রাইভেট টিউটর হিসেবে পড়িয়ে থাকেন।  বেশিরভাগ শিক্ষার্থী দিনে দুই-তিনটি টিউশনি করাতে পারতো, এখন ঢাকা শহরের যানজটের কারণে মাত্র একটি করাতে পারে। ফলে, আয়ের ক্ষতি পোষাতে আগের চেয়ে বেশি বেতন দরকার তাদের।

বই ও কপির দামও বেড়েছে: বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক বিক্রেতা সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট শ্যামল পাল টিবিএস-কে বলেন, কাগজের আকাশচুম্বী দাম বৃদ্ধির কারণে বই ও কপির দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন তারা।   আগে প্রতি টন কাগজ ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করতাম। এখন এই দাম বেড়ে ৭০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। একারণে দাম বাড়ানো ছাড়া আমাদের উপায় নেই।

 ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মানজুর আহমেদ বলেন, এ দেশের মানুষ এখন আর্থিক সংকটে ভুগছে। অনেক অভিভাবক সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারছেন না। অনেক অভিভাবক এ কারণে ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু এভাবে তারা খুব বেশিদিন চলতে পারবেন না। একারণে সরকারের শিক্ষার পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া উচিৎ।  টিউশন ফি ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট খরচের কিছু অংশ দেওয়া উচিৎ সরকারের। সরকার সরাসরি স্কুল কর্তৃপক্ষকে এ অর্থ দিতে পারে। অন্যথায়, এ সংকট আরও গভীর হবে।

দেশজুড়ে প্রায় ২ লাখ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার্থী আছে প্রায় ৪.৫ কোটি। এরমধ্যে ৪০ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ছে।  বাংলাদেশে ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে শহরের পরিবারগুলোর প্রাইভেট টিউশনের জন্য খরচ বেড়ে ৪৮ শতাংশ থেকে ৬৭শতাংশ হয়েছে। শহরের বাইরে এ খরচ ২৭ শতাংশ থেকে ৫৪ শতাংশ হয়েছে।

বাংলাদেশে শিক্ষার মোট খরচে শিক্ষার্থীদের পরিবারকে বহন করতে হয় দুই-তৃতীয়াংশ। এক-তৃতীয়াংশ দেয় সরকার। এদিক দিয়ে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। হাইতি, নাইজেরিয়া ও লাইবেরিয়ার পর বাংলাদেশের অবস্থা।  এমনকি ফ্রি পাবলিক শিক্ষারও অনেক লুকোনো খরচ আছে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে পরিবার থেকে দেওয়া শিক্ষা খরচের এক তৃতীয়াংশই আসে পাবলিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের পরিবার থেকে।

অন্যান্য দেশে পরিস্থিতি : ইউনেস্কোর ২০২১/২ গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্টে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী ছয়টি পরিবারের একটি পরিবারকে সন্তানের স্কুল ফি দিতে টাকা জমাতে হয়, নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশের ৮ শতাংশ (১২টির মধ্যে একটি) পরিবারকে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে ঋণ নিতে হয়।  উগান্ডা, হাইতি, কেনিয়া ও ফিলিপাইনের মতো কিছু দেশে, ৩০ শতাংশ পরিবারকে সন্তানের শিক্ষা খরচ মেটাতে ঋণ করতে হয়।

সবার জন্য এক বছরের প্রাক-প্রাথমিক ও ১২ বছরের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার খরচ দেওয়ার সরকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষার আহ্বান জানানো হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।  নতুন তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোতে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পরিবারগুলোর ওপর শিক্ষা ব্যয়ের চাপ বাড়ছে। নিম্ন ও নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশগুলোতে, শিক্ষার জন্য পরিবার খরচ করে ৩৯ শতাংশ, বাকি খরচ করে সরকার। উন্নত দেশে পরিবারের খরচের হার ১৬ শতাংশ।

পরামর্শ : ইউনেস্কোর সবচেয়ে জোর দেওয়া পরামর্শ হলো, এক বছরের প্রাক-প্রাথমিক এবং ১২ বছরের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার সরকারি অর্থায়নের প্রচেষ্টা বাড়ানো।  পরিবারের আয় ও খরচের জরিপ চালিয়ে আউট-অব-পকেট খরচ পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার সরকারের।  


আরও খবর