পাকিস্তানি
হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্যাতনের শিকার বীরাঙ্গনাদের সন্তানদের ‘যুদ্ধশিশু’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে এ বছর
(২০২২ সাল) এ সংক্রান্ত কোনও আদেশ জারি করা সম্ভব হচ্ছে না। চলছে যাচাই-বাছাই। এতে
কিছুটা সময় লাগছে। ফলে পরিকল্পনা থাকলেও আসন্ন বিজয় দিবসের (১৬ ডিসেম্বর) আগে বা পরে এ সংক্রান্ত কোনও প্রজ্ঞাপণ জারি করা
সম্ভব হচ্ছে না। তবে আগামী স্বাধীনতা দিবসের (২৬ মার্চ) আগে এ আদেশ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন
জারি করা হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানিয়েছে,
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের নির্যাতন-নৃশংসতার
শিকার নারীদের সন্তানদের ‘যুদ্ধশিশু’ হিসেবে
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের
(জামুকা) ৮২তম বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির পর যুদ্ধশিশুদের
চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বা রাষ্ট্রীয় অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাবার নাম লেখার
প্রয়োজন হবে না। বাবার নাম ছাড়াই তারা রাষ্ট্রের সব সুবিধা বা অধিকার ভোগ করতে পারবেন।
জানা গেছে,
চলতি বছর সেপ্টেম্বরে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত পচি
বেগমের সন্তান মেরিনা খাতুনের যুদ্ধশিশু হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার আবেদন করেন।
এরপরই এ সিদ্ধান্ত নেয় জামুকা। প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে।
মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, ১৯৭১
সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী দুর্বৃত্তদের ধর্ষণের
শিকার হয়ে বাঙালি নারীরা যে শিশুদের জন্ম দেন তাদের যুদ্ধশিশু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
একটি ইতালীয় চিকিৎসক দলের সমীক্ষায় যুদ্ধশিশু জন্মদানকারী নারীর সংখ্যা ৪০ হাজার বলা
হয়েছে। লন্ডনভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান্ড প্যারেন্টহুড ফেডারেশনের (আইপিপিএফ)
হিসাব অনুযায়ী এই সংখ্যা দুই লাখ। একটি সরকারি হিসাবে এ সংখ্যা তিন লাখ বলে উল্লেখ
করা হয়। তবে এ সংখ্যা নির্ধারণে অনুসৃত পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য বলা যায় না।
একাত্তর পরবর্তী
সময়ের সংবাদপত্রে যুদ্ধশিশুদের নিয়ে যত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, সেগুলোর মধ্যে দুঃস্থ
মহিলা পুনর্বাসন বোর্ডের সভাপতি বিচারপতি কে.এম সোবহান, মিশনারিজ অব চ্যারিটির সিস্টার
মার্গারেট মেরি এবং আইপিপিএফ-এর ড. জিওফ্রে ডেভিস, ওডার্ট ফন শুল্জ প্রমুখের সাক্ষাৎকারও
ছিল। তাদের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, স্থানীয় বাঙালি চিকিৎসকদের সহায়তায় ব্রিটিশ,
মার্কিন ও অস্ট্রেলীয় চিকিৎসকদের একটি দল ঢাকায় বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ২৩ হাজার
বীরাঙ্গনার গর্ভপাত ঘটান। ১৯৭২ সালের শুরুতে এই তথ্য প্রকাশিত হয়। এরপর বিদেশ থেকে
চিকিৎসক দল বাংলাদেশে আসতে শুরু করেন। তারা ঢাকায় গর্ভপাত করানো বা সন্তান জন্মদানের
জন্য ‘সেবা
সদন’ নামে পরিচিত
বেশ কয়েকটি চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলেন।
বিদেশি নাগরিকরা
যাতে যুদ্ধশিশুদের সহজে দত্তক নিতে পারে সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ পরিত্যক্ত শিশু (বিশেষ
বিধান) আদেশ ১৯৭২ নামে একটি রাষ্ট্রপতি আদেশ জারি করা হয়। ১৯৭২ সালের ১৯ জুলাই ১৫ জন
যুদ্ধশিশুর প্রথম দলটি বাংলাদেশ থেকে কানাডায় পৌঁছালে গণমাধ্যমে এ সংবাদটি ব্যাপকভাবে
প্রচারিত হয়। ১৯৭৪ সালে যুদ্ধশিশু প্রশ্নটির অবসান ঘটে। ততদিনে দত্তক হিসেবে বিদেশের
মাটিতে যারা যাওয়ার, তাদের অভিবাসন সম্পন্ন হয়; আর যারা স্বদেশে রয়ে যায় তারা স্বজনদের
কাছে বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু তাদের কোনও রাষ্ট্রীয়
স্বীকৃতি ছিল না। বাবার নাম উল্লেখ করতে না পারায় তারা কোনও সুযোগ-সুবিধাও পেতেন না।
পরবর্তীতে একটি আবেদনের পর সরকার তাদের স্বীকৃদি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অবশেষে রাষ্ট্রীয়
স্বীকৃতি পাচ্ছেন দেশে বসবাসকারী যুদ্ধশিশুরা।
এ প্রসঙ্গে
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খাজা মিয়া জানান, আমাদের কাছে একজন বীরাঙ্গনার
সন্তান আবেদন করেছিলেন। তার আবেদনের পর জামুকার বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবটি গৃহীত
হয়।
জামুকা সূত্রে
জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত পচি বেগমের সন্তান
মেরিনা খাতুন সেখানকার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে গত ৮ সেপ্টেম্বর যুদ্ধশিশু হিসেবে রাষ্ট্রীয়
স্বীকৃতি চেয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদনটি পাঠান। এরপর গত ১০ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক
মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ওই আবেদনটি জামুকার বৈঠকে উত্থাপনের নির্দেশ দেন।
এ প্রসঙ্গে
জানতে চাইলে ৬ ডিসেম্বর বিকেলে টেলিফোনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল
হক বলেন, যারা যুদ্ধশিশু, তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে। পিতার নাম ছাড়াই তারা
যেন রাষ্ট্রীয় সব সুবিধা বা অধিকার ভোগ করতে পারেন, সে জন্যই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এ বছরের বিজয়
দিবসের আগেই এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপণ জারি করা হবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান,
প্রস্তাবটি কেবিনেটের অনুমোদনের পর প্রজ্ঞাপণ জারি করা হবে। আশা করছি আগামী ২৬ মার্চ
(২০২৩ সাল) স্বাধীনতা দিবসের আগেই এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে। তিনি জানিয়েছেন, বীরাঙ্গনার
সন্তানেরাই যুদ্ধশিশু হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবেন।
জানা গেছে,
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে (এমআইএস) গেজেটভুক্ত
বীরাঙ্গনার সংখ্যা হালনাগাদ নয়। সরকারি তালিকায় এখন পর্যন্ত বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার
সংখ্যা ৪৪৮ জন থাকলেও এমআইএসে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ৪০২ জনের নাম। এর মধ্যে ৮৯ জন বীরাঙ্গনারই
নামে রয়েছে বানানসহ বিভিন্ন ধরনের ভুল।
গত দুই বছর
ধরে ধারাবাহিকভাবে যুদ্ধশিশুদের নিয়ে কাজ করছে নারীপক্ষ। যুদ্ধশিশুদের স্বীকৃতি দেওয়া
নিয়ে সরকারের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরিন
হক বলেন, দুই বছর আগে শহীদ মিনারে আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা এই স্বীকৃতির দাবি তুলেছিলাম।
কাজটি মোটেই সহজ নয়। যারা দত্তক নেওয়ায় বিদেশে চলে গিয়েছিলো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ।
কিন্তু যারা দেশের ভেতরে রয়ে গেছেন তাদের নিয়ে কাজ করা কঠিন।
বাংলাদেশের
নারী অধিকার সংগঠন ও অ্যাক্টিভিস্টরাও বিষয়টিতে যুক্ত হতে দেরি করে ফেলেছেন উল্লেখ
করে তিনি আরও বলেন, বীরাঙ্গনাদের নিয়ে গত ১০ বছর কাজ করতে গিয়ে মাথায় এলো, এদের অনেকে
সেসময় অন্তসত্ত্বা হয়েছিলেন। তাদের কী হলো? এমনকি গর্ভাবস্থার ছয় মাস পেরিয়ে যাওয়ার
পরেও অনেক ঝুঁকি নিয়ে গর্ভপাত করানো হয়েছিল। এসব অনেকটাই অজানা রয়ে গেলো। তিনি বলেন,
একটা কমন ঘোষণার দাবি করি- সব যুদ্ধশিশুকে নাগরিকত্ব দেওয়া হোক। তাদের জানানো হোক,
এটা তোমাদেরও দেশ।