Logo
শিরোনাম

অনন্য উপমা ও চিত্রকল্পের কবি

প্রকাশিত:শনিবার ০৫ নভেম্বর ২০২২ | হালনাগাদ:রবিবার ২৬ নভেম্বর ২০২৩ | ১৯২০জন দেখেছেন
নিউজ পোস্ট ডেস্ক

Image

সাগর জামান

জীবনানন্দ দাশ আধুনিক বাংলা কবিতার এক অনন্য কবি। তার কবিত্ব শক্তি তুলনারহিত। বাংলা কবিতাকে আধুনিকতার পথে ধাবিত করতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। তার কবিতায় পরাবাস্তবতা লক্ষ্য করা যায়। আলাদা কাব্য দর্শন ও চিত্রকল্প উপমায় শিল্প নৈপুণ্য তার কবিতাকে করে তোলে অত্যুজ্জ্বল। রবীন্দ্র, নজরুল পরবর্তীকালে বাংলা কবিতার জগতে তিনি ছিলেন পুরোধা। গ্রামবাংলার অপরূপ সৌন্দর্য তার কবিতায় লীলায়িত। তার কবিতা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে প্রকৃতি ও দেশজ উপাদানে। রূপকথা বাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও পুরাণ তার কবিতাকে করে তুলেছে চিত্রকল্পময়। তার কবিতার শিল্পসফল চিত্রকল্প ও উপমার ব্যবহার পাঠকদের চিত্ত জয় করে। সে কারণেই তিনি রূপসী বাংলার কবির অভিধায় ভূষিত হয়েছেন। পাশাপাশি তিনি আখ্যায়িত হয়েছেন নির্জনতার কবি, মহাপৃথিবীর কবি বলে।

অন্যদিকে তিনি শুদ্ধতম কবির উপাধি লাভ করেছেন।বহু খেতাবপ্রাপ্তি অবশ্যই বিরল অর্জন।জীবনানন্দের কাব্য প্রতিভার কারণে তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এত  পরিচয়সূচক উপনাম । জীবদ্দশায় তিনি সমাদৃত ছিলেন না। জীবিতাবস্থায় জীবনানন্দ দাশ ছিলেন অনেকটা অপ্রকাশিত। তার মৃত্যুর পরেই তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তার কবিতা বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। অজ্ঞাত জীবনানন্দ দাশ ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠেন এবং তিনি বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষে পরিণত হন। জীবনানন্দ দাশ অত্যন্ত সার্থক ও পরিপূর্ণভাবে  তার কবিতায় পরাবাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। তার কবিতায় শিল্পিত কারুকার্য গভীরতা ও আধুনিকতার পরশ লক্ষ্য করা যায়। জীবনানন্দ দাশের একান্ত নিজস্ব লৈখিক রীতি আধুনিকতা তার কবিতাকে করে তুলেছে সৌন্দর্যস্নাত। তার কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তি সুগঠিত। তার কবিতার নান্দনিক মাত্রাবিন্যাস পাঠকদের মনোযোগ কেড়ে কবিতার গভীরে নিয়ে যায়।

কালের প্রবাহে জীবনানন্দ দাশের হৃদয়স্পর্শী কবিতার আবেদন একটুও ক্ষুণ্ণ হয়নি। বরং আরো বেশি প্রাসঙ্গিক আরো বেশি উজ্জ্বল হয়েছে। তিনি লোকান্তরিত হওয়ার পর যতদিন অতিবাহিত হচ্ছে, ততই তিনি উদ্ভাসিত হচ্ছেন। তার কবিতার জগৎ উন্মোচিত হচ্ছে নতুন প্রজন্মের কাছে। নতুন প্রজন্ম তার কবিতায় অনুরক্ত হয়ে পড়ছে ব্যাপকভাবে। প্রকৃতি জীবনানন্দের কাছে ধরা দিয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ- রূপসী বাংলা, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, বেলাঅবেলা কালবেলা, শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রভৃতি। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী কবি। তিনি প্রচলিত নিয়ম ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিসত্তার জাগরণ ঘটে পারিবারিক পরিম-ল থেকে। তার পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, বরিশাল ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র এবং ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।

জীবনানন্দের মাতা কুসুমকুমারী দাশ কবিতা লিখতেন।  আদর্শ ছেলে শীর্ষক কবিতার রচয়িতা তিনি। এই অত্যন্ত সুপরিচিত (আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে) পরিবার থেকে উৎসাহিত হয়ে জীবনানন্দের কাব্যচর্চার শুরু বালক বয়স থেকেই। স্কুলে ছাত্রাবস্থায় তার প্রথম কবিতা বর্ষা- আবাহন ব্রহ্মবাদী পত্রিকায় ১৯১৯ সালে প্রকাশিত হয়। মূলত কবি হলেও তিনি অসংখ্য ছোটগল্প, কয়েকটি উপন্যাস ও প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরাপালক প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। এই গ্রন্থের কবিতায় নজরুলের প্রভাব বোঝা যায়। জীবনানন্দের প্রকৃত কাব্য প্রতিভার স্ফুরণ প্রথম দিকের কবিতায় দেখা যায় না। পরবর্তীতে তিনি অন্য কবিদের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বতন্ত্রপথ আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছেন। তখন তার কবিতা নতুন রূপ সৌন্দর্যে অবারিত আলোয় উৎফুল্ল­। এসময় জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বহুমাত্রিকতা সূচিত হয়। মূলত ধূসর পান্ডুলিপি প্রকাশিত হওয়ার পর তার কাব্য প্রতিভার আসল পরিচয় পাওয়া যায়।বিশুদ্ধ কবিতাকে সঙ্গী করে তিনি পথ হেঁটেছেন। প্রকৃতি তার চিত্তে আলোড়ন তোলে। ঝরাপালক কাব্যে প্রকৃতির কথা উঠে এসেছে। তিনি প্রকৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করেছেন বিভিন্ন সময়ের কবিতায়। প্রকৃতি তার কবিতাকে স্নিগ্ধ ও সৌন্দর্যময় করে তুলেছে। ঝরাপালক এ প্রকৃতির পাশাপাশি ইতিহাস ও মৃত্যুচেতনা স্মৃতি মগ্নতা ধরা পড়েছে তার কবিতায়। ঝরাপালকে নজরুলের স্পষ্ট প্রভাব যেমন টের পাওয়া যায়, পাশাপাশি বিশ্ব সাহিত্যের সুর জীবনানন্দ দাশের কবিতায় অনুরণিত হয়েছে। পাশ্চাত্য রীতি অনুসরণ করে তিনি কবিতা লিখেছেন । পাশ্চাত্য রীতিতে তিনি প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তবু তার কাব্য প্রতিভা বক্তব্যের ভিন্নতা রচনাশৈলী তাকে প্রসিদ্ধ করেছে।

বনলতাসেন শীর্ষক কবিতাটি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে চিহ্নিত। এই কবিতাটি সুধী মহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। কালোত্তীর্ণ এ কবিতাটি জীবনানন্দ দাশকে কবিতা রচনার ক্ষেত্রে পারঙ্গমতার স্বীকৃতি দিয়েছে। এ কবিতাটি খ্যাতি বৃদ্ধি যেমন করেছে, তেমনি তাকে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিতা রচনার মর্যাদায় নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে । কবিতাটি বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্য কাগজ কবিতায় ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হয়। প্রেমের আবেশে মুহ্যমান  এই কবিতাটি ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা লাভ করে। জীবনানন্দ দাশ এক রহস্যময় নারীর প্রতি প্রেমের অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন এই কবিতার বুননে। শিল্পিত উপমা উৎপ্রেক্ষা প্রয়োগ করে তিনি তার মানস প্রতিমার রূপ বর্ণনা করেছেন। যা পাঠকদের উদ্দীপ্ত করে। মানসপ্রতিমার দীঘল চুল, চোখ ও মুখাবয়বের সৌন্দর্যের প্রকাশ করেছেন শৈল্পিক উপমায়।

বনলতা সেনে  ভ্রমণবিলাসী এক কবির পরিচয় পাওয়া যায়। অন্ধকারকে সহযাত্রী করে পৃথিবীর পথে মানুষের অবিরাম পরিভ্রমণ করে যাওয়ার কথা বলেছেন তিনি কাব্যের ছন্দে। গভীর জীবনবোধ, না পাওয়ার বেদনা, প্রেম, সান্নিধ্য পিপাসা, তিমিরাচ্ছন্নতা, শান্তির আকুতি, উৎসারিত হয়েছে এ কবিতায়। তিনি দয়িতার সান্নিধ্যে শান্তি সুধা পান করার কথা ব্যক্ত করেছেন । নতুন ভাবনা সুন্দর কাব্যদর্শন এই কবিতায় প্রযুক্ত হয়েছে। জীবনানন্দ দাশ প্রেমময় ভাবনায় অবগাহিত হয়েছেন । মানুষ ইতিহাসের পথে অবিরাম হেঁটে যায়। সুখ দুঃখকে আলিঙ্গন করে নেয় মানুষ। এক বিভ্রান্ত পথিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তিনি। হেঁটে যেতে যেতে নানা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে পৌঁছে গেছেন গন্তব্যে, পৃথিবীর বিভিন্ন ভৌগোলিক স্থানে। কখনো কখনো তার যাত্রা হয়েছে আলো থেকে অন্ধকারে। তার হৃদয়বৃত্তিতে প্রেম জেগে উঠেছে। একটু মানসিক শান্তির জন্য তিনি ছুটে গেছেন তার প্রণয়নীর কাছে। এসব কথা শিল্পিত শব্দ ও উপমার অলঙ্কারে বিবৃত হয়েছে জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন শীর্ষক কবিতায়।

জীবনানন্দ দাশ গতানুগতিকতার মধ্যে বন্দি থাকেননি। নতুনত্বের উন্মুক্ত প্রান্তরে থেকে কবিতা রচনা করেছেন। প্রকৃতি তার কবিতার প্রধান উপাদান। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগে তিনি মগ্ন থেকেছেন। তার কবিতায় প্রকৃতির নানা রূপ ফুটে উঠেছে। প্রকৃতির নানা বৈচিত্র্য ধরা পড়েছে। জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির সঙ্গে প্রেমের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন শিল্পসফলভাবে। ফলে, তার কবিতায় চমৎকার রোমান্টিক পরিবেশ অনুধাবন করা যায়।

রোমান্টিক মানস প্রবণতা, স্বদেশ, প্রকৃতি বন্দনা, প্রেম তার কবিতায় একীভূত হয়েছে। ব্যক্তিক অনুভূতি, একাকিত্ব, দুঃখ-কষ্ট, হাহাকার বিচিত্র জীবনবোধ, অন্তর্গত বেদনার অনুরণন শোনা যায় তার কবিতায় । তিনি ব্যক্তিগত অনুভূতি,অন্তর্দহন, আলাদা বোধকে ভিত্তি করে কবিতা রচনায় নিমগ্ন হয়েছেন। যাপিত জীবনের বিচিত্র অনুভব ও অনুভবের ভেতরের অনুভব, বোধের ভেতর জেগে ওঠা বোধ তার কবিতায় উন্মোচিত হয়েছে। অদ্ভুত এই বোধ তার কবিচিত্তকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে।

জীবনানন্দ দাশ তার অন্তর্গত বোধকে কাব্য চেতনায় ধারণ করেছেন। অদ্ভুত এক বোধের তন্তুজালে আটকে যাওয়ার কথা তুলে ধরেছেন। নাছোড় এই বোধ তাকে জড়িয়ে রাখে সবসময়। এই বোধের জন্য সবটা তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। বোধের শৃঙ্খল থেকে তিনি মুক্ত হতে পারেন না কখনো। এই কবিতায় শূন্যতাবোধের গভীর উপলব্ধি ধরা পড়েছে। উপস্থাপনা ভঙ্গি, বিষয় বৈভব, বহুমাত্রিক বক্তব্য রীতি, উপমার প্রয়োগ জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে উদ্ভাসিত করেছে। এ কথা দ্বিধাহীন চিত্তে উচ্চারণ করা যায় যে, বিশুদ্ধ কবিতার হাত ধরে বাংলা কবিতা জগতে বিচরণ করেছেন মহান ও শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ।

নিউজ ট্যাগ: জীবনানন্দ দাশ

আরও খবর

একেক শিশুর পছন্দ একেক ধরনের বই

শনিবার ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

খুলে গেল কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার গেট

মঙ্গলবার ৩১ জানুয়ারী ২০২৩